শোকাহত রাবি ক্যাম্পাস হিমেলের লাশ, রিমেলের যন্ত্রণা আর ক্যাম্পাসে পোড়া গন্ধ
আপডেটঃ ৪:৫৯ অপরাহ্ণ | ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০২২
নিউজ ডেস্কঃ
রাস্তার পাশে বালুতে ছোপ ছোপ রক্ত।রক্তের ওপর কে যেন রেখে গেছেন পাঁচটি লাল গোলাপ।পাশেই পড়ে আছে একটি টুপি, একটি মাফলার আর মোটর সাইকেলের হেড লাইটের বিচ্ছিন্ন অংশ।সামান্য দূরে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে একটি মোটর সাইকেল।তার পাশেই পুড়ে অঙ্গার হওয়া চারটি ট্রাক।রাস্তার অন্যদিকে আরেকটি।গত মঙ্গলবার রাতে ট্রাকচাপায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবিব হিমেল (২৪) নিহত হওয়ার পর ক্যাম্পাসে থাকা এসব ট্রাকে আগুন দেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাতে যাওয়ার সাহস করেনি।তাই বুধবার সকালেও পুড়ছিল ট্রাকগুলো।ধোঁয়া আর টায়ারের পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল ক্যাম্পাসে।দুর্ঘটনার স্থানে হিমেলের মাফলার, টুপি, রক্ত আর দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া মোটর সাইকেলের পাশে দাঁড়িয়ে দিনভর চোখের পানি ফেলছেন সহপাঠীরা।
ঘটনার সময় হিমেলের সঙ্গে মোটর সাইকেলে ছিলেন সিরামিক ও ভাস্কর্য বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রায়হান প্রামাণিক রিমেল (২৪)।দুর্ঘটনায় তাঁর পায়ে জখম হয়েছে।রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের শয্যায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি।যন্ত্রণ, ক্যাম্পাসের বড় ভাইকে হারানোর।
রিমেলের বর্ণনা অনুযায়ী, রাতে তাঁরা দুজনে ক্যাম্পাসের হাবিবুর রহমান হলের সামনে দিয়ে বিশ্ব-বিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের দিকে যাচ্ছিলেন।মোটর-সাইকেল চালাচ্ছিলেন হিমেল।পেছনে আসছিল পাথর বোঝাই ট্রাক।ট্রাকটিকে সাইড দিতে হিমেল রাস্তার পাশে থেমে যান।ওই সময়ই ট্রাকটি আশপাশ না দেখে বাঁয়ে ঘুরিয়ে মাঠের ভেতরে ঢুকে যায়।
ট্রাকের ধাক্কায় রিমেল ছিটকে পড়লেও মোটর সাইকেলসহ ট্রাকের চাকার নিচে পড়েন হিমেল।এতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাঁর মাথা।রাবিতে এখন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে।পুড়িয়ে দেওয়া ট্রাকগুলো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের।প্রতিটি ট্রাকেই ভর্তি করা ছিল পাথর।গতকাল বুধবার দুপুরে ট্রাকের চালক মো. টিটু (৪২) ও চালকের সহকারী হামিম হোসেন ওরফে কালুকে (২০) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বিশ্ব-বিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ড. আরিফুর রহমান দুজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।শিক্ষার্থীরা হিমেলের মৃত্যুকে ‘দুর্ঘটনা’ বলতে নারাজ।তাঁরা বলছেন, এটি হত্যাকাণ্ড।মঙ্গলবার রাতে হিমেলের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লেই উত্তাল হয়ে ওঠে রাবি ক্যাম্পাস।শিক্ষার্থীদের একাংশ ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে ক্যাম্পাসের সামনে বিক্ষোভ করে।
অন্য আরেকটি দল উপাচার্য ভবনের সামনে বিক্ষোভ করে।আরও একটি দল বিক্ষোভ করতে থাকে ক্যাম্পাসেই উপুড় হয়ে পড়ে থাকা হিমেলের লাশ ঘিরে।তাঁরা পাঁচটি ট্রাক ও নির্মাণাধীন ভবনের শ্রমিকদের থাকার ছাউনিতে আগুন দেন।মহাসড়ক ঘিরে থাকায় রাতেই ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সড়কটি বন্ধই ছিল।
রাত পৌনে ১টার দিকে ক্যাম্পাসে আসেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনে মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার।পরে আসেন উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার।
এ সময় শিক্ষার্থীরা প্রক্টর ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের প্রত্যাহার, চালককে গ্রেপ্তার, হিমেলের পরিবারকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ, পরিবারের সদস্যকে চাকরি দেওয়া, ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করাসহ সাত দফা দাবি জানান।রাত পৌনে ২টার দিকে শিক্ষার্থীদের সাত দফা লিখিত দাবি গ্রহণ করে বাসভবনে ঢোকেন উপাচার্য।
এরপর শিক্ষার্থীরা হলে ফেরেন।গতকাল বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আসাবুল হককে প্রক্টর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।অর্থাৎ, ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর লিয়াকত আলীকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।গতকাল সকাল পৌনে ১০টার দিকে হিমেলের লাশের কফিন প্রথমে চারুকলা অনুষদে রাখা হয়।
এরপর লাশ বিশ্ব-বিদ্যালয় শহীদ মিনারের মুক্ত মঞ্চে নেওয়া হয়।এ সময় হিমেলের সহপাঠী ও অন্য শিক্ষার্থীরা ডুকরে কাঁদতে থাকেন।মুক্তমঞ্চে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে কফিনে ফুল দিয়ে হিমেলের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।এরপর জানাজা শেষে একটি পিকআপ ভ্যানে করে লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি নাটোরের উদ্দেশে রওনা হন হিমেলের মা মুনিরা আক্তার ও মামা মো. মুন্না।
সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িতে যান উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তারসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।শিক্ষার্থীরাও রাবির ৮টি বাসে করে নাটোর যান।নাটোর সদরের গাড়িখানা কেন্দ্রীয় গোরস্থানে তাঁর মরদেহ দাফন করা হয়েছে।
** পরিবার পেল ৫ লাখ টাকা নাটোরের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে হিমেলের মায়ের কাছে ৫ লাখ টাকার চেক দেন উপাচার্য।এ সময় হিমেলের অসুস্থ মায়ের আজীবন চিকিৎসার ব্যয় রাবি কর্তৃপক্ষ বহন করবে বলেও জানান উপাচার্য।এ ছাড়া আহত অপর শিক্ষার্থী রিমেলের চিকিৎসার সব খরচ বহন করা হবে বলেও তিনি জানান।
** হিমেলের বাবা আগেই মারা গেছেন।মা অসুস্থ।হিমেলের দাদার বাড়ি বগুড়া।নাটোরে হিমেলের নানার বাড়িতেই থাকেন তাঁর মা।বগুড়া ও নাটোরেই হিমেলের পড়াশোনা।তারপর ভর্তি হয়েছিলেন রাবিতে।পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় পড়াশোনার পাশাপাশি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা এবং সেলস অফিসার পদে চাকরি করেছেন হিমেল।
পড়াশোনা শেষ পর্যায়ে আসার পর আঁকাআঁকি আর কাঠের শিল্পকর্মে মন দিয়েছিলেন।এগুলো বিক্রি করে নিজেই পড়াশোনার খরচ জোগাতেন, মায়ের কাছেও টাকা পাঠাতেন।
** হিমেলের নামে ভবন হবে রাবিতে হিমেলের নামে বিশ্ব-বিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন ২০ তলা একাডেমিক ভবনের নামকরণের আশ্বাস দিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার।গতকাল বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবাশ বাংলার মাঠে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের আলোচনায় শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এ আশ্বাস দেন।
উপাচার্য বলেন, হিমেলের মায়ের যাবতীয় আর্থিক প্রয়োজনের দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে।আপাতত তাঁর মায়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।এ ছাড়া, আমি শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি।তাঁর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ফান্ড থেকে একটি অ্যামাউন্ট আনার চেষ্টা করব।যেন একটি এফডিআর করা হলে হিমেলের মা প্রতি মাসে ৩৫-৪০ হাজার টাকা পান
IPCS News : Dhaka : আবৃুল কালাম আজাদ : রাজশাহী।