রাসিকের ৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের রাস্তায় উঠে যাচ্ছে কার্পেটিং
আপডেটঃ ৩:০৭ অপরাহ্ণ | নভেম্বর ০৪, ২০২৪
নিউজ ডেস্কঃ
রাজশাহী:-রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর অবকাঠামো প্রকল্পের আওতায় ৩০টি ওয়ার্ডে উন্নয়নকাজ চলমান রয়েছে।এরই অরেক রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।তিন বছর মেয়াদী এ উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ গত জুনে শেষ হয়েছে।এরই মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বৃদ্ধির জন্য প্রস্তবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।তবে এখনো অধিকাংশ কাজ বাকিই রয়েছে।কিন্তু যেসব রাস্তার কাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, সে গুলোর ওপরের অংশের পিচঢালা পাথর উঠে যাচ্ছে।এতে করে নিম্নমাণের নির্মাণসামগ্রি ব্যবহার ও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে এ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে।অভিযোগ আছে, প্রতিটি উন্নয়ন কাজে রাসিকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আগে ২৫ % পর্যন্ত কমিশন আদায় করতেন।এর বাইরে প্রকৌশলীরা নেন ৫% কমিশন।এতে সিডিউল অনুযায়ী কাজের মাণ রেখে কাজ করতে পারছেনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গুলো।
তবে সিটিকর্পোরেশনে বিভাগীয় কমিশনার প্রশাসকের দায়িত্ব নেওয়ার পরে এখন অনেকটায় পরিস্থিতি ভালো হলেও প্রকৌশলী দপ্তরের কমিশন বানিজ্য থামেনি।স্থানীয়রা বলছেন, যেসব রাস্তা নিমার্ণ বা সংস্কার করা হয়েছে সেসব রাস্তায় পাথরের পরিবর্তে অধিকাংশ ইটের খোয়া ব্যবহার করা হয়েছে।সে গুলোও নতুন ইটের খোয়ার বদলে দেয়া হয়েছে বাড়ি ভাঙ্গা পুরনো ইটের খোয়া।
অন্যদিকে নির্মিত রাস্তার ওপরের অংশে যে পরিমাণ বিটুমিন ও পাথর দিয়ে কার্পেটিং করার কথা ছিল, সেখানেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।ফলে ছয় মাস না যেতেই ওয়ার্ড পর্যায়ের সবগুলো রাস্তার কার্পেটিং উঠে যাচ্ছে।সরেজমিন রাজশাহী নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
স্থানীয়দের দাবি, ড্রেন, ফুটপাত ও রাস্তা নির্মাণ বা সংস্কারের সময় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঠিকাদাররা ব্যাপক অনিয়ম করেছেন।
এলাকাবাসীর পক্ষে নগর কর্তৃপক্ষ ও রাসিকের প্রকৌশলীদেরকে ফোন করে বার বার অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি।উল্টো ঠিকাদাররা ইচ্ছামতো কাজ করে গেছেন দাপটের সঙ্গে।কারণ সমস্ত কাজেরই দেখভাল করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।ফলে তাদের দাপটে ঠিকাদাররা দায়সারা কাজ করে সরকারি অর্থ লোপাটের মহোৎসবে লিপ্ত ছিলেন।
নগরীর বিলসিমলা এলাকার সাইফুল ইসলাম বলেন, রাজশাহী বিভাগীয় স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তাটি মাত্র মাস দুয়েক আগে নির্মাণকাজ শেষ করেছে ঠিকাদার।ওইসময় রাস্তায় যেসব খোয়া ফেলানো হয়েছিল, তার অধিকাংশই ছিলো বাড়ি বা রাস্তার পুরনো ইটের খোয়া।আবার এক ইঞ্চিও পাথর দেওয়া হয়নি কার্পেটিংয়ের সময়।
বিটুমিনের পরিমাণও ছিল নামেমাত্র।ফলে তিন মাস না যেতেই রাস্তসটির কার্পেটিং উঠতে শুরু করেছে।কিছু দিনের মধ্যে পুরোন চিত্রে আবার খানা-খন্দে পরিনত হবে।একই অভিযোগ করেন নগরীর কয়েরদাঁড়া এলাকার আব্দুর ওয়াহব।তিনি বলেন, এই এলাকার ভিতর দিয়ে যাওয়া রাস্তাটির সংস্কারকাজ সম্প্রতি শেষ করা হয়েছে।
রাস্তাটি এতটাই নিম্ন মানের যে এখনি কার্পেটিং উঠে যাচ্ছে।এখানে দায়সারা কাজকরে সরকারি অর্থ লুট করেছে।এই এলাকায় বর্ষায় জলাবদ্ধতা নিরাসনে যে ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে সেটি কোনোই কাজে আসছে না।অন্যদিকে ড্রেন নির্মাণের সময় নিম্নমাণের সামগ্রি ব্যবহার করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরীর ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৬ কোটি ৮০ লাখ টাকার উন্নয়ন প্যাকেজের আওতায় মহিষবাথান ঈদগাহ থেকে হড়গ্রাম বাজার ও কারিতাস মোড় থেকে রাজপাড়া মোড় পর্যন্ত ১ দশমিক ৩ কিলোমিটার গড়ে ৪ মিটার প্রশস্ত রাস্তাটি সংস্কার হয়।
কিন্তু এই দুটি রাস্তারই এর মধ্যে কার্পেটিং উঠতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন ঐ এলাকায় বসবাস কারি হাবিবুর রহমান নামের এক ব্যক্তি।রাসিকের তথ্যমতে, সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের অধীন তিনটি প্যাকেজে ৮টি ওভারপাস বা ফ্লাইওভার ও ১৯টি ছোট-বড় অবকাঠামো নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে।
এছাড়াও চলমান রয়েছে, ৮৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরীর হড়গ্রাম নতুনপাড়া লেভেল ক্রসিংয়ে ও ওভারপাস নির্মাণকাজ, ১১৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকাব্যয়ে কোর্ট স্টেশন রেলওয়ে ক্রসিংয়ে ৫২১ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থ ওভারপাস, ২০৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয়ে শহিদ কামারুজ্জামান চত্বর লেভেল ক্রসিংয়ে ৮৯৭ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থ ওভারপাস নির্মাণ, ১১৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ভদ্রা লেভেল ক্রসিংয়ে ৫২০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থ ওভারপাস নির্মাণ, ২৯১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে বন্ধ গেট এবং নতুন বিলসিমলা লেভেল ক্রসিং পর্যন্ত ১ হাজার ২৫৫ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১২ মিটার প্রস্থ সমন্বিত ওভারপাস নির্মাণকাজ।
এরই মধ্যে প্রকল্পগুলোর ২০-০০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।তবে এসব কাজেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।রাসিক সূত্র মতে, একই প্রকল্পের আওতায় ১৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহী মহানগরীর রাজশাহী-নওগাঁ প্রধান সড়ক থেকে মোহনপুর-রাজশাহী-নাটোর সড়ক পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিম সংযোগ সড়ক নির্মাণ, ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহী মহানগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণে নর্দমা নির্মাণ, ১২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর কল্পনা সিনেমা হল থেকে তালাইমারি মোড় পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন, ১৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহী মহানগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার উন্নয়ন এবং ৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে সড়ক ও নর্দমাসমূহের উন্নয়ন।
সূত্র আরও জানায়, নতুন এই প্রকল্পের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশনে অযান্ত্রিক যানবাহন লেনসহ চারলেন সড়ক নির্মাণ করা রয়েছে ১৩ দশমিক ১০ কিলোমিটার, কার্পেটিং সড়ক নির্মাণ ৩৬৮টি; কার্পেটিং সড়ক পুননির্মাণ ২৫৮টি, কার্পেটিং সড়ক প্রশস্তকরণ ৫৩টি, সিমেন্ট কনক্রিট সড়ক নির্মাণ এক হাজার ৮০৭টি, ফুটপাত নির্মাণ ৪১ দশমিক ৯২ কিলোমিটার, গোরস্থান ও জলাশয়ের পাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করার কথা রয়েছে ৬২ দশমিক সাত কিলোমিটার।জলাশয়সমূহে সৌন্দর্যবর্ধনমূলক কাঠামো নির্মাণ ১৯টি।
গণশৌচাগার নির্ম ৩০টি, পার্ক নির্মাণ চারটি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ, ৮টি ফুটওভার ব্রিজ, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ৫০টি, কাঁচাবাজার চারটিসহ জলাশয় খনন ও সড়ক আলোকায়নসহ ৬৯টি ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করার কথা রয়েছে।এসব কাজের অধিকাংশই সম্পন্ন হয়েছে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, এসব কাজেও ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে।
ফলে এরই মধ্যে রাস্তার ধারে ফুটপাতের টাইলসগুলো উঠে যাচ্ছে।ফুটপাতের স্লাব হারিয়ে গেছে।জনসাধারণের চলাচলও ঝুঁকিরমুখে পড়েছে। জলাসময়সমূহে সৌন্দর্যবর্দ্ধন করতে গিয়ে ছোট করে ফেলা হয়েছে পুকুরগুলো। আর পকেটে ভরেছে ঠিকাদার ও প্রকৌশলী এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
রাসিকের একটি সূত্র জানায়, প্রতিটি উন্নয়ন কাজে রাসিকের প্রকৌশলীরা অন্তত ৩-৫ পার্সন্টে কমিশন আদায় করেন।
সরকারি প্রকল্পে অলিখিত দুই ভাগ কমিশন আদায় করেন প্রকৌশলীরা। সেখানে রাসিকের প্রকৌশলীরা আদায় করেন তিন ভাগ। এতে কাজের মাণ আরও খারাপ হচ্ছে। এর বাইরে রাসিকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আদায় করতেন ২৫-২৫ ভাগ। সবমিলিয়ে রাসিকের উন্নয়ন কাজে অন্তত ২৫ ভাগ টাকা হত টেবিলে টেবিলে ভাগ-বাটোয়ারা। তবে এখনো বেপরোয়া প্রকৌশলীরা কমিশন ছাড়া কোনো বিল ছাড় করেন না বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক ঠিকাদার।
উন্নয়নের নামে নিম্নমাণের কাজ ও অনিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে রাসিকের ভারপ্রাপ্ত তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহম্মদ আল মইন বলেন, আমি নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। এসব নিয়ে এখন কোনো মন্তব্য করতে পারব না। রাসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড,এবিএম শরীফ উদ্দিন বলেন, কোনো কাজে অনিয়ম হয়ে থাকলে, সেগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে কাউকেই এখন আর নিম্নমাণের কাজ করতে দেওয়া হবে না।
IPCS News : Dhaka : আবুল কালাম আজাদ : রাজশাহী:।