সোমবার ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সংবাদ শিরোনামঃ

রাজশাহীতে চ্যালেঞ্জের মুখে বেত শিল্প

আপডেটঃ ৮:০৬ অপরাহ্ণ | সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২১

নিউজ ডেস্কঃ

ধুকে ধুকে কোনমতে টিকে আছে বেত শিল্প।একসময় গৃহস্থালি থেকে শুরু করে আবসাবপত্র তার সবাই হতো এই বেতের।দামে সস্তা ও নাগালের মধ্যে থাকায় বেশ কদরও ছিল।তবে কালের বিবর্তনে বেতের তৈরি জিনিসের জায়গা দখলে নিয়েছে প্লাস্টিক ও লোহা।তাই দিন দিন কমেছে বেতের তৈরি জিনিসের চাহিদাও।তবে দুঃজনক হলেও সত্য বেত নিয়ে অফিসিয়ালী কোন তথ্য নেই রাজশাহী বিসিক, রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও রফতানী উন্নয়ন ব্যুরোর কাছে।ফলে বেতের বাণিজিক ও চাষের তথ্য মেলেনি এই সমস্ত দফতরগুলো থেকে।জানা গেছে, বর্তমানে রাজশাহীর হোসনিগঞ্জে (বেতপট্টি) তিনটি ও বহরপুর বাইপাস এলাকায় পাঁচটি বেতের তৈরি আসবাবপত্র বিক্রির দোকান রয়েছে।মাত্র আটটি দোকানে বিলপ্তি হতে যাওয়া বেতের আসবাবপত্র পাওয়া যায়।বেতের এই সমৃদ্ধ শিল্পটি বাঁচানো এখন বড় চ্যালেঞ্জ।দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেছে- বেত দিয়ে তৈরি চেয়ার, টেবিল, মোড়া, ডালা, কুলা, চাঙ্গারী, চালোন, ধামা, পাতি, বই রাখার তাক, সোফা, দোলনা, খাট পাওয়া যাচ্ছে।

তবে ১০ বছর আগেও ধান-চাল মাপার কাজে ব্যবহার হতো বেতের তৈরি কাঠা।এখনও গ্রামের কিছু কিছু বাড়িতে এর দেখা মেলে।বর্তমানে রাজশাহীর বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট, ঘর বা অফিসের শৌখিন পার্টিশন হিসেবে এর ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে।এছাড়া লম্বা বেত ফালা করে নানা কিছু বাঁধার কাজেও ব্যবহার করা হয়।শুধু তাই নয়- এক সময় বেত স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের হাতে থাকতো।

পড়া-শোনা না পাড়লে বেতের পিটুনি খেতে হয়েছে।তবে তা আর চোখে না; পড়লেও সড়কে পুলিশের হাতে দেখা মেলে বেতের লাঠি।এই বেতগাছে সুন্দর ফুল ও ফল ধরে।সাধারণত অক্টোবর মাসে বেতগাছে ফুল আসে।ফুল ধরার আগমুহুর্তে গাছ থেকে একধরনের মিষ্টি ঘ্রাণ আসে।তখন মৌমাছি, পিঁপড়া, মাছি আসে সেই রস খাওয়ার জন্য।এর পরে ফুল থেকে ফল ধরে।

একে সাধারণত বেত ফল বলা হয়।তবে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে ডাকে যেমন-বেত্তুন, বেথুল, বেতগুলা, বেত্তুইন ইত্যাদি।বেত ফল দেখতে গোলাকার বা একটু লম্বাটে গোলাকার হয়।আকারে ছোট ও স্বাদ কষযুক্ত টক-মিষ্টি।বেতফল মার্চ-এপ্রিল মাস নাগাদ পাকে।প্রতিটি থোকায় ১০০টির বেশি ফল ধরে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, একসময় রাজশাহী নগরীর হোসনিগঞ্জ বেতপট্টিতে রাস্তার দু’পাশে কমপক্ষে ১২ থেকে ১৪টি দোকান ছিল।এখন সিদ্দিক, ফরিদুর রহমান ও আব্দুল কাদেরের দোকান ছাড়া চোখে পড়েনা।তবে দোকানগুলোতে বেতের তৈরি কিছু কিছু জিনিপত্র পাওয়া গেলেও তুলনায় কম।ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক সময় এই বেতপট্টির দু’পাশে ১২ থেকে ১৪টি দোকান ছিল।

কিন্তু বেতের তৈরি জিনিসের চাহিদা কমায় অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন।এখন মাত্র তিনটি দোকান রয়েছে।দোকানগুলোতে বেতের পাশাপাশি বাঁশের তৈরি মালামালও বিক্রি হয়।তবে বেতের তৈরি মালামালগুলো নগরের বহরমপুর বাইপাস থেকে কিনে এখানে বিক্রি করা হয়।কারিগর ফুয়াদ হোসেন জানান, ‘আমার বাবা খাইরুল ইসলামও এই পেশায় ছিলেন।

তিনি দীর্ঘদিন এই কাজ করেছেন।বাবার সাথে থেকে কাজ দেখতে দেখতে এখন এটা পেশার মানুষ আমিও।১২ থেকে ১৫ বছর ধরে এই কাজ করছি।মুজরির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন কাজের অবস্থা ভালো না।বেতের কাজের চেয়ে বাঁশের জিনিসপত্রের অর্ডার বেশি।একটি সাইকেলর ঝুঁড়ি তৈরি করলে ৫০ টাকা পায়।

আবার মালিক সেই ঝুঁড়ি বিক্রি করে ১০০ থেকে ১৮০ টাকা দরে।ব্যবসায়ী ফরিদুর রহমান জানান, আগে বনজঙ্গল বেশি ছিল।তাতে বেত চাষ হতো।ফলে দেশের নঁওগা, দিনাজপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে বেত আনা হতো অল্প দামে।এখনও রাজশাহীতে সিলেট, চট্টগ্রাম ছাড়াও বিদেশ থেকে বেত কিনে কাজ করতে হয়।

তাতে দাম কয়েকগুন বাড়লেও তেমন বাড়েনি বেতের তৈরি জিনিসের দাম।তিনি আরো জানান, চাহিদা কমে যাওয়ায় এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় কারিগর পাওয়া যায়না।সবমিলে বেত সঙ্কট, শ্রমিক সঙ্কট, বাজারে পণ্যের চাহিদা কম থাকায় ধুকছে এই শিল্পটি।এই শিল্পকে বাঁচানো এখন চ্যালেঞ্জ ছাড়া আর কিছু না।

কারণ আমাদের বয়স হয়েছে।বিকল্প পেশায় যাওয়া সম্ভব নয়।কার এই পেশায় নতুন করেও কেউ আসছেন না।অন্যদিকে পাঁচ-ছয় বছরের বেশি সময় থেকে নগরের বহরমপুর বাইপাসে তিনটি দোকান তৈরি করা হয় বেতের তৈরি আসবাবপত্রের।এখন সবমিলে মর্ডান, বিচিত্রা, মদিনা, কেইন প্লাজায় বেতের তৈরি আসবাবপত্র পাওয়া যাচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যবসা আর আগের মত হয় না।বেতের আসবাবপত্রের চাহিদা কম।তার পরেও যারা বেতের জিনিস ব্যবহার করেছেন, তারাই বেশি কেনেন।কারণ এটা ঘুনে ধরে কম, নষ্টও কম হয়।বিচিত্রার দোকানের কারিগর আব্দুর রাজ্জাক জানান, সবচেয়ে বেশী উৎপন্ন বেত ইন্দোনেশিয়ায়।

ইন্দোনেশিয়ায় উৎপন্ন বেতের গুণগতমানও সবচেয়ে উন্নত।এছাড়া ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, মায়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডেও বেত জন্মায়।তবে রাজশাহীতে মিয়ানমার (বার্ম), ইন্দোনেশিয়া ও ভারত থেকে বেত আসে।ইন্দোনেশিয়ার বেতের দাম সবচেয়ে বেশি।মিয়ানমার থেকে আসা প্রতিটি বেতের দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা।

যা ১০ থেকে ১২ ফুট লম্বা।এছাড়া দেশি বেত মোটা ১০০ টাকা ও পাতলা (ফালি বেত) ২৫ থেকে ৫০ টাকা।ভাতীয় বেত কিনতে হয় ১০০ থেকে ২০০ টাকা।এছাড়া ইন্দোনেশিয়ার বেত ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা।যা ১০ থেকে ১২ ফুট লম্বা।আর ফালি (পাতলা) বেত ৭০০ টাকা কেজি।বিচিত্রার বিক্রেতা আহম্মেদ আলী উদ্দিন জানান, চেয়ার বিক্রি হয় প্রতিটি ২ হাজার থেকে ৭ হাজার পর্যন্ত।

সোফা সেট ১৪ হাজার থেকে শুরু করে ৭০ হাজার, মোড়া ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা, ৬ সেটের ডাইনিং ১৫ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা।এছাড়া ঘাট ৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।নগরের ডিঙ্গাডোবা এলাকার আফসানা মিনি জানান, বাবার বাড়িতে বেতের জিনিস ব্যবহার করেছে।অনেক ভালো লাগতো।

তাই আমি বাঁশ ও বেতের শিল্পের আসবাবপাত্র দিয়ে ঘর সাজিয়েছি।কিন্তু বাঁশে ঘুণ ধরে নষ্ট হয়।তবে বেতে ঘুন ধরলেও অনেক বছর ব্যবহার করা হয়।তিনি আরো বলেন, এখন অল্প মূল্যে প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিল কিনেছি।ইদানিং প্লাস্টিকের আসবাব গুলো বিভিন্ন ডিজাইনে তৈরি করায় দেখতেও ভালো লাগছে।তার পরেও আমার বাসায় বেতের তৈরি জিনিসপত্রই বেশি।

রাজশাহীতে বেতের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে উপপরিচালক কেজেএম আব্দুল আউয়াল ও রফতানী উন্নয়ন ব্যুরো রাজশাহীর সহকারি পরিচালক সাইদুর রহমান জানান, তাদের কাছে অফিসিয়ালী কোন তথ্য নেই।তবে রাজশাহী বিসিকের কাছে তথ্য না থাকলেও উপ-মহাব্যবস্থাপক জাফর বায়েজীদ বলেন, আমরা এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।

ব্যবসায়ীরা আমাদের তাদের সমস্যার কথাগুলো জানালে, আমরা সেইভাবে কাজ করবো।এছাড়া এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত থাকা মানুষগুলোকে প্রশিক্ষণ ও আর্থিকভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করবো।

IPCS News Report : Dhaka : আবুল কালাম আজাদ : রাজশাহী।