মিটার গেজকে ডুয়াল গেজ রূপান্তর প্রকল্পরেলের ৪ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগই গচ্ছা
আপডেটঃ ২:৫০ অপরাহ্ণ | অক্টোবর ০৯, ২০২১
নিউজ ডেস্কঃ
চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মিটার গেজ রেলপথ বসিয়ে কয়েক বছর যেতে না যেতেই তা তুলে ফেলার পরিকল্পনা করছে রেলওয়ে।প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা খরচে রেলওয়ের লাকসাম-চিনকি আস্তানার মিটার গেজ রেলপথটি এক লাইন থেকে দুই লাইনে উন্নীত করার কাজ শেষ হয় ২০১৫ সালে।অন্যদিকে টঙ্গী-ভৈরববাজার রেলপথটি প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ডাবল লাইন মিটার গেজ তৈরি করা হয়, যার কাজ ২০১৮ সালে শেষ হয়।দুটি রেলপথই ডুয়াল গেজ ডাবল লাইন করার উদ্যোগ নিয়েছে রেলওয়ে।এর মধ্যে শুধু লাকসাম-চিনকি আস্তানার মিটার গেজ রেলপথটি ডুয়াল গেজ করতেই খরচ হবে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।পরিকল্পনা অনুযায়ী, ডুয়াল গেজ লাইন বসানোর জন্য বিদ্যমান মিটার গেজ লাইন দুটি পুরোপুরি তুলে ফেলতে হবে।নতুন করে তৈরি করতে হবে সেতু-কালভার্ট।সিগন্যাল ও টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থা বদলাতে হবে।
বানাতে হবে স্টেশন বিল্ডিং।সঙ্গে অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে বিপুল পরিমাণ জমি।এসব কাজ বাস্তবায়নে শুধু লাকসাম-চট্টগ্রাম অংশেই খরচ ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা।রেলওয়ের এমন পরিকল্পনাকে মারাত্মক রকমের অদূরদর্শী হিসেবে দেখছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।তারা বলছেন, ছয় বছর আগে লাকসাম-চিনকি আস্তানায় যে উন্নয়ন প্রকল্পটি শেষ হয়েছে, সেটির মাধ্যমেই লাইন দুটি কম খরচে মিটার গেজের বদলে ডুয়াল গেজ করা সম্ভব ছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) প্রকৌশলীরা বলছেন, রেললাইনে বিনিয়োগ অন্তত ১০০ বছরের হিসাব করে করতে হয়।সেখানে চার-পাঁচ বছরের মাথায় রেলপথ তুলে যদি আবার নতুন করে বানাতে হয় তাহলে তা হবে মারাত্মক রকমের অদূরদর্শী পরিকল্পনা।এর মাধ্যমে একদিকে যেমন রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হচ্ছে, তেমনি জনগণ পড়তে যাচ্ছে চরম ভোগান্তিতে।
হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে যে মিটার গেজ ডাবল লাইন করা হলো তার সুবিধা তো যাত্রীরা পেলই না, উল্টো নতুন রেলপথ নির্মাণকাজের জন্য ফের দীর্ঘ সময়ের জন্য ভোগান্তিতে পড়বে তারা।দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন এ রেলপথ নিয়ে এমন অদূরদর্শী পরিকল্পনা ক্ষমার অযোগ্য।২০০৬ সালে টঙ্গী-ভৈরব মিটার গেজ রেলপথ উন্নয়ন প্রকল্প শুরু হয়।
শুরুতে নির্মাণ ব্যয় ছিল ৭২৫ কোটি টাকা।কয়েক ধাপে ব্যয় ও মেয়াদ বেড়ে বেড়ে প্রকল্পটি শেষ হয় ২০১৮ সালে।সব মিলিয়ে ব্যয় হয় প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা।প্রকল্পের আওতায় ৬৪ কিলোমিটার মিটার গেজ ডাবল লাইন, ২২ কিলোমিটার লুপ লাইন, চারটি বড় সেতু, ৩৬টি ছোট সেতু, ৩১টি কালভার্ট, ১১টি স্টেশন বিল্ডিংসহ কম্পিউটার বেজড সিগন্যালিং ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়।
অন্যদিকে লাকসাম-চিনকি আস্তানার মিটার গেজ রেলপথটি উন্নয়নের জন্য ২০০৭ সালে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।শুরুতে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫০১ কোটি টাকা, যা কয়েক দফায় সংশোধন হয়ে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়।ডাবল লাইনটি উদ্বোধন করা হয় ২০১৫ সালে।টঙ্গী-ভৈরব বাজার ও লাকসাম-চট্টগ্রাম দুটিই ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের অংশ।
রেলপথটিতে মিটার গেজ ডাবল লাইন বিদ্যমান।ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মাঝের আখাউড়া-লাকসাম অংশটিতে বর্তমানে ডুয়াল গেজ ডাবল লাইনে উন্নীতের কাজ চলছে।তবে লাকসাম-চট্টগ্রাম রেলপথের প্রকল্পটি যে সময় গ্রহণ করা হয়েছিল তখন রেলওয়ের উন্নয়নে খুব বেশি বরাদ্দ পাওয়া যেত না উল্লেখ করে বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক একজন মহাপরিচালক বলেন, মূলত এ কারণেই সেই সময় রেলপথটি ডুয়াল গেজ করা হয়নি।
বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছে।সরকার রেলওয়ের উন্নয়নেও বিনিয়োগ কয়েক গুণ বাড়িয়েছে।এরই ধারাবাহিকতায় এখন মিটার গেজ লাইনগুলো ব্রড বা ডুয়াল গেজ করা হচ্ছে।সম্প্রতি লাকসাম থেকে চিনকি আস্তানা হয়ে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী পর্যন্ত মিটার গেজ ডাবল লাইন রেলপথটি ডুয়াল গেজ ডাবল লাইন করার জন্য একটি প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) প্রস্তুত করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
পিডিপিপির তথ্যানুযায়ী, লাকসাম-চিনকি আস্তানা-পাহাড়তলী পর্যন্ত রেলপথটির দৈর্ঘ্য ১৩১ কিলোমিটার।ডুয়াল গেজ ডাবল লাইনসহ আনুষঙ্গিক রেলপথ সব মিলিয়ে ৩৭১ দশমিক ৭ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করতে হবে অংশটিতে।প্রকল্প প্রস্তাবে শুধু রেললাইন নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা।জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিপূরণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে খরচ হবে ১ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা।
২ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা খরচ হবে ভূমি উন্নয়নে।স্টেশনসহ প্রয়োজনীয় বিল্ডিং নির্মাণে খরচ হবে ১ হাজার ২৫২ কোটি টাকা।আরো প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে সিগন্যাল ও টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থা স্থাপনে।পিডিপিপির তথ্য অনুযায়ী, সব ধরনের অবকাঠামোসহ লাকসাম-চিনকি আস্তানা-পাহাড়তলীর প্রতি কিলোমিটার ডুয়াল গেজ লাইন নির্মাণে খরচ হবে ৪২ কোটি ২ লাখ টাকা।
আর শুধু রেললাইন বসানোর কাজে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হবে ১৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।অন্যদিকে ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা বাদ দিলে প্রতি কিলোমিটার রেলপথ বানাতে খরচ পড়বে ৩৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা।বিপরীতে যদি শুধু রেলপথ, সেতু, কালভার্ট ও স্টেশন বিল্ডিংয়ের হিসাব করা হয়, তাহলে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হবে ২০ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
সব মিলিয়ে প্রকল্পটির জন্য ১৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে।এর মধ্যে ১২ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে উন্নয়ন-সহযোগীদের কাছ থেকে।বাকি প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা নেয়া হবে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে।২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ধরা হয়েছে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সম্ভাব্য মেয়াদ।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, মিটার গেজ আর ব্রড গেজ জটিলতা বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি বড় সমস্যা।ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ মিটার গেজ।অন্যদিকে দেশের উত্তর আর পশ্চিমাঞ্চলে যেসব রেলপথ রয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগই ব্রড গেজ।এ কারণে চট্টগ্রামের সঙ্গে দেশের অন্য জায়গাগুলোয় সরাসরি যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না।
রেলে পণ্য পরিবহনের বিষয়টিও বলতে গেলে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যেই সীমিত।বিষয়গুলোকে আমলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ঢাকা-চট্টগ্রামের পুরো রেলপথটি ডুয়াল গেজ ডাবল লাইনে উন্নীত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ডুয়াল গেজ ডাবল লাইন করার কাজ অনেকটাই শেষ হয়েছে।বাকি অংশের কাজও দ্রুত শেষ করা হবে।
IPCS News Report : Dhaka : আবুল কালাম আজাদ : রাজশাহী।