মালিকানাধীন জমি দখলে নিতেই রাজশাহীর আলোচিত ‘ফোর মার্ডার’
আপডেটঃ ১২:৪০ অপরাহ্ণ | জুলাই ২৪, ২০২৩
নিউজ ডেস্কঃ
রাজশাহী:- গত ১০ জুলাই হামলায় ৪ জন নিহতের ঘটনা, ওয়াক্ফ এস্টেটের জমি নয় বরং মালিকাধীন জমি জোরপূর্বক দখল করতেই জমির মালিক সোহেল রানাসহ তার তিন বর্গাচাষিকে পিটিয়ে ও পরে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে নৃশংস ভাবে কুপিয়ে হত্যা করে ভূমিদস্যুরা।এলাকায় দুর্ধর্ষ ভূমিদস্যু হিসেবে পরিচিত আশিকুর রহমান চাঁন, জালাল মেম্বারসহ তার বাহিনী পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হামলা এই চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করে।বিবাদমান জমিটির বিষয়ে খোঁজখবর নিতে গিয়ে জমির কাগজপত্র বিশ্লেষণে মালিকানাধীন জমির বিষয়টি উঠে এসেছে।তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বিবাদমান জমিটি ১৯৬৯ সালে মানিক উদ্দিন শেখের ছেলে তমির উদ্দিন চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ক্রয় করেন রাজশাহী মহানগরীর বোয়ালিয়া থানার সুলতানাবাদ এলাকার খন্দকার মুনসুর আলির ছেলে খন্দকার মোজাম্মেল হক দারোগা।
এই জমি ক্রয়ের পর ১৯৭০ সালের ২৬ ডিসেম্বর নামজারির (খজনা খারিজ) জন্য আবেদন করেন।পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে ২৭ নভেম্বর এই জমির খজনা খারিজ সর্ম্পণ হয়।যার প্রস্তাবিত খতিয়ান নাম্বার ২৫৫ এবং মূল খতিয়ান নং ৪৩৭।আরোও উল্লেখ্য খন্দকার মোজাম্মেল হক দারোগা বিবাদমান এই জমি বাদেও আরও জমি ক্রয় করেন।
সূত্র জানায়, দীর্ঘ ৫২ বছর ধরে ক্রয় সূত্রে জমিটি ভোগদখল করছিলেন জমির মালিক খন্দকার মোজাম্মেল হক দারোগা।এরপর ২০১৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মোজাম্মেল হক মারা গেলে এই জমির বৈধ ওয়ারিশ হন তার ১১ সন্তান।এই ওয়ারিশগণের কাছ থেকে জমিটি সামশুজ্জোহা, সোহেল রানা, মঞ্জুর রহমান ও আমজাদ হোসেন ক্রয় করে ভোগদখল করে আসছেন।
এই ১৪ বিঘা জমি হতে ৪ জনের কাছ থেকে ১.৫৩৩৩ একর জমি ক্রয় করেন নিহত সোহেল রানা।এই জমি ক্রয়ের পর চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি সামশুজ্জোহা, সোহেল রানা এবং মঞ্জুর রহমান নামজারি তথা খাজনা খারিজের জন্য স্থানীয় ভূমি অফিসে আবেদন করেন।
আবেদনটি সরেজমিন যাচায়-বাছাই করে উপজেলার কাকনহাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহকারী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম গত ৫ মার্চ, উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার ও কানুনগো মোক্তারুজ্জানের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেন এবং সার্ভেয়ার জাহাঙ্গীর আলম সকল প্রকার নথি যাচাই করে গত ১২ মার্চ নামজারি অনুমোদনের জন্য গোদাগাড়ীর সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর কাছে প্রেরণ করেন।
যা গত ১৪ মার্চ, সর্বশেষ সকল প্রকার নথি যাচাই করে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সবুজ হাসান জমিটির নামজারি অনুমোদন দেন। যার প্রস্তাবিত খতিয়ান নং ১৯৮৮।জমিটির বিভিন্ন রেকর্ড খতিয়ান থেকে জানা যায়, ১৯২০ সালের সিএস রেকর্ডে জমির মূল প্রজা নীপেন্দ্র নাথ।আর রায়তি বা বর্গাচাষী গেন্দু শেখ।
১৯৬২ সালের রেকর্ডে অর্থাৎ এস এ রেকর্ডে এই জমির মূল প্রজা রেনু কণা দেবী ও বীণা কণা দেবী।রায়তি বা বর্গাচাষী হাজি মানিক উল্লাহ শেখ।১৯৭২ সালের আরএস রেকর্ডে এই জমির মালিক খন্দকার মোজাম্মেল হক।তবে এই জমিটি হত্যা মামলার প্রধান আসামি আশিকুর রহমান চাঁন তাদের হাজি মানিউল্লা শেখ ওয়াক্ফ এস্টেটের জমি দাবি করলেও জমির সিএস, এসএ এবং আরএস রেকর্ডেও কোথাও তার নাম নেই।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গোদাগাড়ীর পাকড়ি ইউনিয়নের মুসরাপাড়া ইয়াজপুর গ্রামেই ১৩৩ একর জমি ওয়াক্ফ এস্টেটের নামে ছিল।অন্যায় ও নিয়মবহির্ভুতভাবে ভুমিদস্যু আশিকুর রহমান চাঁদ এই ওয়াক্ফ এস্টেটের মোতায়াল্লি হয়।চাঁনের নজর পড়ে এই ১৩৩ একর জমির পাশের জমিগুলোতেও।ওয়াক্ফ এস্টেটের পাশেই সোহেল রানার মালিকানাধীন জমিটি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে চাঁন।
সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, গত ১০ জুলাই সকালে চাঁন তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে সোহেল রানার জমি দখল করতে মাঠে যায়।এসময় ওই জমিটিতে ধান রোপন করছিলেন বর্গাচাষিরা।চাঁন ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী বর্গাচাষিদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়।খবর পেয়ে জমির মালিক সোহেল রানা ঘটনাস্থলে গেলে চাঁন ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী সোহেল রানার ওপর হামলা চালিয়ে তাকে ঘটনাস্থলেই খুন করে।
এসময় তারা আরো তিন বর্গাচাষিকেও হত্যা করে।অনুসন্ধানে আরো উঠে এসেছে, হত্যা মামলার প্রধান আসামি আশিকুর রহমান চাঁন ওয়াক্ফ এস্টেটের জমির নামে ওই এলকায় ৪৬ বিঘা সরকারি খাস জমি দীর্ঘদিন জবরদখল করে রাখে।যা সম্প্রতি ইউএনও’র নেতৃত্বে জমিটি দখলমুক্ত করা হয়।পরে সেখানে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ন প্রকল্পের ৪২টি বাড়ি নির্মাণ করা হয়।
ঘর গুলো ভূমিহীনদের কাছে হস্তান্তরের আগেই চাঁন জমিটি পুনরায় নিজের কব্জায় নিতে উচ্চ আদালতে রীট পিটিশন দাখিল করে।ফলে ভূমিহীনদের মাঝে সেই ঘর গুলো এখনো হস্তান্তর করা সম্ভব হয়নি।ভূমিদস্যু আশিকুর রহমান চাঁনের সহোদর ভাই সেলিম রেজা বলেন, ‘চাঁন এই ওয়াক্ফ এস্টেটের মোতায়াল্লি হয়েছে অবৈধভাবে।এই বিষয়ে চাঁনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
শুধু তাই নয়, অবৈধ মোতায়াল্লি হয়ে গত ৫ বছর ধরে ওয়াক্ফ এস্টেটের ৪২ জন অংশিদারকে বঞ্চিত করে ইতি মধ্যে প্রায় ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।ক্রয় সূত্রে জমির আরেক মালিক মঞ্জুর রহমান বলেন, জমিটি যদি হাজি মানিক উল্লাহ শেখ ওয়াক্ফ এস্টেটের হতো তাহলে ব্রিটিশ থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত যত রেকর্ড আছে তার কোন না কোন রেকর্ড খতিয়ানে উল্লেখ থাকতো।
কিন্তু কোন রেকর্ডেই এই জমি হাজি মানিক উল্লাহ শেখ ওয়াক্ফ এস্টেটের নাম নেই।এই সর্ম্পত্তি সর্ম্পণ ব্যক্তি মালিকানাধীন।সঠিক কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেই আমরা এটা ক্রয় করেছি।তিনি আরও বলেন, ‘হামলাকারী আশিকুর রহমান চাঁন একজন বড় মাপের সন্ত্রাসী ও ভমিদস্যু।তার কাজই অন্যের জমি অন্যায়ভাবে দখল করা।
সেদিনও পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে আরেক জমির মালিক সোহেল রানার জমি দখল করতে গিয়ে অতর্কিত হামলা চালিয়ে সোহেলসহ চারজনকে হত্যা করে।এবিষয়ে জানতে তৎকালীন (সদ্য বিদায়ী) উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সবুজ হাসান বলেন, নামজারি তথা খাজনা খারিজের জন্য আবেদনের পর সর্ব প্রথম সরেজমিন যাচায়-বাছাই করেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহকারী কর্মকর্তা।
পরে উপজেলা ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার ও কানুনগো আবারও যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন দাখিল করেন।এরপর তৃতীয় ধাপে সকল প্রকার নথি যাচাই অন্তে চুড়ান্ত নামজারি অনুমোদন দেয়া হয়।আমার জানামতে, ওই জমিটিও ওয়াকফ ষ্টেটের নয়।তিনি আরও বলেন, ওয়াকফ স্টেটের কোন জমি রেজিস্ট্রি হওয়ারই কথা না।সাব-রেজিস্ট্রার তা করতেই পারবে না এবং করবে না।
আর জমির নামজারি হয় মূলত রেকর্ডিয় খতিয়ান মূলে।আর এখনতো ভূমি অফিসের নামজারিসহ অন্যান্য কাজ ডিজিটাল পদ্ধতিতেই হচ্ছে।এখানে ভূয়া কোন কাজ করার সুযোগ নেই।গোদাগাড়ী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামরুল ইসলাম বলেন, জমি নিয়ে বিরোধে ৪ জন নিহতের ঘটনাটি পরিকল্পিত।
এখানে কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি।সংঘর্ষ হলে অবশ্যই প্রতিপক্ষের কেউ না কেউ গুরুতর আহত কিংবা নিহত হতেন।বরং একটি পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর পরিকল্পিত হামলা চালিয়ে চারজনকে হত্যা করেছে।তিনি আরো বলেন, ‘জমির কাগজ-পত্র বিশ্লেষণ করে আমরাও দেখেছি, এটি ওয়াকফ এস্টেটের নয় বরং ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি।
এই বিষয়ে গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সঞ্জয় কুমার মোহন্ত বলেন, ‘সংঘর্ষের দিন তাৎক্ষণিকভাবে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয়দের বক্তব্যের আলোকে জেলা প্রশাসক মহাদয়কে একটি ‘অবহিতকরণ প্রতিবেদন’ দিয়েছিলাম।সেখানে ডিসি অফিসের এক কর্মচারির নাম উল্লেখ ছিল।কিন্তু পরবর্তীতে জানতে পারি, সে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়।
বরং তিনি নিহত সোহেল রানার খালাতো ভাই।তিনি আরো বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলাটি গুরুত্বসহকারে দেখছে।আশা করছি, অপরাধী যেই হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উল্লেখ্য, গত ১০ জুলাই হামলায় ৪ জন নিহতের ঘটনায় ওই দিন রাতেই আশিকুর রহমান চাঁনকে প্রধান আসামি করে ২১ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৪০-৫০ জনের নামে নিহত সোহেল রানার ভাই সুমন বাদি হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।এই মামলায় ১০ আসামি গ্রেপ্তার হলেও প্রধান আসামি চাঁনসহ অন্যরা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
IPCS News : Dhaka : আবুল কালাম আজাদ : রাজশাহী।