বিকল রেডিওলোজি সিস্টেম ইণ্জিন দিয়ে চলছে ট্রেন, নেই হ্যান্ডব্রেকও ভয় পাচ্ছেন চালকেরা
আপডেটঃ ১২:৪৮ অপরাহ্ণ | জুলাই ১৪, ২০২৪
নিউজ ডেস্কঃ
রাজশাহী:- ট্রেনের ইঞ্জিনের রেডিওলোজি সিস্টেমও বিকল হয়ে গেছে প্রায় শত বছর আগেই।চালকের তিনটি হ্যান্ডব্রেকের দুটি বিকল।ইঞ্জিনের সেফটি ডিভাইস ডেডম্যান ফুট প্যাডেল দুটি বিকল।দুর্ঘটনার সময় ব্যবহার করা ইমার্জেন্সি ব্রেকই নেই।চালকরাও পুরোনো এসব ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চালাতে চাইছেন না।২৬৩টি ইঞ্জিনের মধ্যে ১৮০ লক্কর ঝক্কর খোদ রেলওয়ের দেয়া তথ্যানুযায়ী, নানা কারণে গত দেড় মাসে রেলের বিভিন্ন স্থানে রেলের ইঞ্জিন বিকল হয়েছে ৬১ বার।এর মধ্যে এপ্রিলে ৪৪ বার ইঞ্জিন বিকল হয়ে ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে বাংলাদেশ রেলবহরে থাকা ২৬৩টি ইঞ্জিনের মধ্যে ১৮০টি অর্থাৎ প্রায় ৬৭ শতাংশই ইঞ্জিন ৫৪ বছরের পুরোনো ও লক্কড়ঝক্কড় ইঞ্জিন দিয়েও চলছে রেল।লে প্রতি বছর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা, কমছে ট্রেনের গতি, ঘটছে শিডিউল বিপর্যয়।গত ১৬ মে রাত ৮টার দিকে গাজীপুরের শ্রীপুরের কাছে ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়।
কতৃপক্ষরা বলছে অতিরিক্ত তাপের কারণে আগুন ধরে ইঞ্জিনটি বিকল হয়ে পড়ে।জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চালান চালকেরা।সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী নিয়ে ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ রুটে চলাচল করা ভাওয়াল এক্সপ্রেস ট্রেনটি গন্তব্যে পৌঁছে দিতে ব্যবহার করা হয় ২৩০০ সিরিজের (এমইএম-১৪) ইঞ্জিন।
প্রায় ৫৪ বছর আগে ১৯৬৯ সালে কানাডা থেকে কেনা এই ইঞ্জিনটির মেয়াদ বা অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল পেরিয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ বছর আগেই।মেরামতের জন্য এসব ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশও পাওয়া যায় না।এই ইঞ্জিনের কোনো ইলেকট্রিক ডিভাইসই এখন কাজ করে না।ইঞ্জিনের রেডিওলোজি সিস্টেমও বিকল হয়ে গেছে বহুদিন আগেই।
চালকের তিনটি হ্যান্ডব্রেকের দুটি বিকল।ইঞ্জিনের সেফটি ডিভাইস ডেডম্যান ফুট প্যাডেল দুটি বিকল।দুর্ঘটনার সময় ব্যবহার করা ইমার্জেন্সি ব্রেকই নেই।চালকরাও পুরোনো এসব ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চালাতে চাইছেন না।তারা বলেন, নিজের জীবনের নিরাপত্তা না থাকার পরও শুধু চাকরি বাঁচাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চালাতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
৪৪ বছর আগেই ইঞ্জিন মেয়াদাতীর্ণ:- পশ্চিমাঞ্চল রেল সূত্রে জানাগেছ,পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগের জন্য ১৯৬১ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত সময়ে ২২০০ থেকে ২৯০০ সিরিজের ৩৩টি ইঞ্জিন কেনা হয়েছিল।
এর মধ্যে ১৯৬১ সালে আমেরিকা থেকে ২২০০ সিরিজের (এমইজি-৯) ১১টি, ১৯৬৯ সালে কানাডা থেকে ২৩০০ সিরিজের (এমইএম-১৪) ৮টি, ১৯৭৮ সালে কানাডা থেকে ২৪০০ সিরিজের (এমইএম-১৪) ৯টি এবং ১৯৮১ সালে হাঙ্গেরি থেকে ৩৩০০ সিরিজের (এমএইচজেড-৮) ৩টি ইঞ্জিন কেনা হয়েছিল।
এসব ইঞ্জিনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ২০ বছর নির্ধারিত থাকলেও আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই।আমেরিকা থেকে আনা ১১টির আয়ুষ্কাল উত্তীর্ণ হয়ে গেছে ৪৪ বছর আগেই।কানাডা থেকে প্রথম ধাপে আনা ৮টির আয়ুষ্কাল২৬ বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে।দ্বিতীয় ধাপে কানাডা থেকে আনা ৯টির আয়ুষ্কালও ১৭ বছর আগে শেষ হয়েছে।
ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, ঈশ্বরদী ও লালমনিরহাটের রেলচালকরা গত ১৩ মে সভা করে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলীদের চিঠি দিয়ে ট্রেনের জরাজীর্ণ দশার কথা জানিয়েছেন।অন্যদিকে আগামী ৩১ মের মধ্যে বগি ও ইঞ্জিন সমস্যার সমাধান করা না হলে কর্মবিরতির হুঁশিয়ারি দিয়ে চিঠি দিয়েছেন ট্রেন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা শ্রমিক-কর্মচারীরা।
মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পথে বিকল হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তারা।চট্টগ্রাম থেকে চলা ছয়টি ট্রেনের ৮০ শতাংশ ব্রেক কার্যকর নয় বলেও জানানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য:- বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ ইঞ্জিনের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে।এ প্রসঙ্গে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক কামরুজ্জামান রিপন বলেন,এই মহুর্তে মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনের পরিবর্তে যদি দ্রুত নতুন ইঞ্জিন ব্যবস্থা না করা হয় তা হলে রেলের পুরো ব্যবস্থাপনাই খাদে চলে যাবে।
ইঞ্জিনের মতো আমাদের বেশিরভাগ রেললাইনও মেয়াদোত্তীর্ণ।একটি রেললাইনের গড় আয়ুষ্কাল ৩০ বছরের মতো।কিন্তু আমাদের বেশিরভাগ রেললাইন স্বাধীনতার আগে তৈরি।ফলে দেশের প্রায় ৬৩ ভাগ রেললাইন বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় এগুলো ট্রেন চলাচলের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।তিনি বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন ও রেললাইনের কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে।
লাইনের ফিশপ্লেট ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না এবং সিগন্যাল, লেভেল ক্রসিং কিছুই ঠিক নেই।আবার বগির সঙ্গে ইঞ্জিনের সংযোগও সঠিকভাবে হয় না।তবে ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করলে এর ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব।সাবেক পশ্চিম রেলের মহা ব্যবস্থাপক খন্দকার শহীদুল ইসলাম বলেন,দায়িত্বে থাকার সময় নানা কারনে অনেক কথা বলা যায়না,দিন দিন রেলের অবকাঠামো নড়বড়ে হয়ে পড়ছে।
বহুবিধ সমস্যায় জর্জরি রেল।কিছু অসাধু নীতি নির্ধারক,আমলারা রেলটাকে টাকা বানানোর মেশিন মনে করেন।চুষে না খেয়ে গিলে খাওয়ায় আজ রেলে এ অবস্থাতিনি আক্ষেপ করে বলেন,গত এক যুগে রেলে ১ লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, তার শতকরা ১ (এক)ভাগও যদি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের কাজে ব্যয় করা হতো, তা হলে রেলের এই করুণ পরিণতি হতো না।
ইতি মধ্যে সুরম্য রেল স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে কিন্তু ইঞ্জিন ও বগি কেনা হয়নি।নতুন নতুন রেলপথ হলেও জনবল নেই।এগুলো দূরদর্শিতার অভাব না জেনে করছেন সেটা তারাই ভালো জানেন ও বুঝেন।পশ্চিম রেলের চীফ অপারেটিং অফিসার( সিওপিএস) আহাসান আলী ভুঁইয়া রেলের উন্নয়ন প্রকল্পের একাধিক সভার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, রেলওয়ের বিদ্যমান মাস্টারপ্ল্যান হালনাগাদ করার পর মেয়াদ ধরা হয়েছে ৩০ বছর (২০১৬-২০৪৫)।
সরকারের ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রেলওয়ে মহাপরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত প্রকল্প পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম ধাপে ৮৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে।
দ্বিতীয় ধাপে ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৬৭টি প্রকল্পে ১ লাখ ১৯ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা, তৃতীয় ধাপে ২০২৬ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ৩৭টি প্রকল্পে ৯৪ হাজার ১৬১ কোটি টাকা, চতুর্থ ধাপে ২০৩১ থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ২৩টি প্রকল্পে ৯৬ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা, ৫ম ধাপে ২০৩৬ সাল থেকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত ১৪টি প্রকল্পে ৮২ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা এবং ষষ্ঠ বা শেষ ধাপে ২০৪০ থেকে ২০৪৫ সাল পর্যন্ত ৬টি প্রকল্পে ব্যয় করা হবে ১২ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা।
কিছুই জানেনা সংশ্লিষ্টরা:-ইঞ্জিন সংকট থাকলেও নতুন ইঞ্জিন ক্রয়ের কোনো প্রকল্প হাতে নেই রেলওয়ের।ফলে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে ইঞ্জিন পাওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।তাদের মতে সমীক্ষা, অনুমোদন, অর্থায়ন, দরপত্র সব প্রক্রিয়া শেষ করে নতুন ইঞ্জিন পেতে কমপক্ষে তিন বছর লাগবে।
তারা জানান, নতুন ইঞ্জিন ক্রয়েরতো কোনো উদ্যোগ নেই, বরং ২০১৯ সালে অনুমোদিত ২১টি ইঞ্জিন মেরামতের প্রকল্পটিও শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়েছে।কর্মকর্তারা জানান, ২১টির মধ্যে তিনটি ইঞ্জিনের অবস্থা বেশি খারাপ ছিল এবং বাকি ১৮টি ইঞ্জিন ভিন্ন প্রকল্পে মেরামতের প্রস্তাবে আগ্রহ দেখায়নি কর্তৃপক্ষ।
তবে অননুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ভারতের ঋণে ৪৬টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন কেনার প্রস্তাব থাকলেও কবে এটি বাস্তবায়ন হবে তা এখনও জানে না রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।তবে ২০৩০ সালের মধ্যে রেলের সব সংকট কেটে যাবে বলে আশাবাদী তারা।
IPCS News : Dhaka : আবুল কালাম আজাদ : রাজশাহী।