ফারাক্কার প্রভাবে পানিশূন্য ৪ নদী, সৃস্টি হয়েছে শোকাবহ পরিবেশ
আপডেটঃ ১:০৫ অপরাহ্ণ | মে ১৭, ২০২৩
নিউজ ডেস্কঃ
রাজশাহী:- ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবস।১৯৭৬ সালের এই দিনে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দান থেকে ভারতের মরণবাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লাখো মানুষের লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়।ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে ওই দিন বাংলার সর্বস্তরের মানুষ যে গগণবিদারী প্রতিবাদ করেছিল তা কাঁপিয়ে দিয়েছিল দিল্লিকে।ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী সেদিন ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব ও এর বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে যে প্রতিবাদ করেছিলেন, তার সেই সাহসী উচ্চারণ বাংলাদেশের মানুষের অনুপ্রেরণা হয়ে আছে আজও।ভারত থেকে বয়ে আসা গঙ্গা নদী বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ঢুকে পদ্মা নদী নাম ধারণ করে।এই নদীকে কেন্দ্রে করেই একসময় এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা চলতো।
তবে সময়ের ব্যবধানে এই নদী এখন এই এলাকার মানুষের দুর্ভোগের কারণ।১৯৭৫ সালে ভারত এই নদীর উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পর বদলে যেতে থাকে এই নদীর গতিপথ।আবার বর্ষা মৌসুমে ছেড়ে দেওয়া পানিতে একদিকে যেমন নদীগর্ভে বিলীন হয় গ্রামের পর গ্রাম, তেমনি শুষ্ক মৌসুমে মাইলের পর মাইল পরিণত হয় ধূ-ধূ বালু চরে।
সেই থেকে ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে যেমন বাড়ছে ভাঙনের প্রবণতা, তেমনি শুষ্ক মৌসুমে ক্রমেই পানির অভাবে মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে চাঁপাই নবাবগঞ্জসহ পদ্মার অববাহিকায় থাকা বিস্তীর্ণ অঞ্চল।ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রত্যক্ষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাঁপাই নবাবগঞ্জের চরাঞ্চলের মানুষ তথা উত্তরাঞ্চলসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল।
ফারাক্কা দিন দিন গ্রাস করছে এ অঞ্চলের মানুষের অধিকার।সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া মানুষের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি নিঃস্ব মানুষগুলোর করুণ আর্তনাদ প্রতিনিয়তই সৃষ্টি করছে শোকাবহ পরিবেশের।উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ভারতীয় সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের বুক চিরে পদ্মা, মহানন্দা, পাগলা ও পুনর্ভবা নদী প্রবাহিত ।
পদ্মা নদীর দৈর্ঘ্য ৪০ কিলোমিটার, মহানন্দা নদীর দৈর্ঘ্য ৯৫, পাগলা নদীর দৈর্ঘ্য ৪১ ও পুনর্ভবা নদীর দৈর্ঘ্য ১৫ কিলোমিটার।চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার পাংখা পয়েন্ট থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে ভারত ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণের কারণে কমছে পানির প্রবাহ।স্বাভাবিক ভাবে পানি প্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় এ নদীগুলো এখন মৃতপ্রায়।
আর ফারাক্কা ব্যারেজের দরজা হঠাৎ খুলে দেওয়ার কারণে বন্যা ও নদী ভাঙন দেখা দেয়।জেলার শিবগঞ্জের আতিকুল ইসলাম, জুয়েল রানা,আমিন বিশ্নাসসহ একাধিক প্রবীন কৃষক জানান, নদী শুকিয়ে গেছে।নদী ও নদীর পাড়ে চাষাবাদ করা ফসলে পানি দিতে হয় শ্যালো মেশিন দিয়ে।কিন্তু গত বছর থেকে শুকিয়ে যাওয়া নদীতে শ্যালো মেশিন দিয়েও পানি উঠছে না।
ফলে আরও গভীরে নলকূপ দিয়ে পানি উঠাতে হচ্ছে।ষাটোর্ধ্ব সাজদার রহমান বলেন, নদীতে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর গতিপথও পাল্টে গেছে।আজকে যেই জায়গায় নদী ছিল, একসময় তা ফসলি জমি ও বসতবাড়ি ছিল।কিন্তু ফারাক্কার কারণে ভারতে পানি বাড়লেই হঠাৎ পানি ছেড়ে দেওয়ায় পানি স্রোত এসে নদী ভাঙন হয়।
এতে করে বসতবাড়ি ও ফসলি জমি নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে ও যাচ্ছে।কৃষক আইনাল হক জানান, শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কা গেইট আটকে দেয়ায় এক ফোঁটাও পানি আসে না।ফলে এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়।এখন বাইরে থেকে কেউ এই এলাকায় আসলে দেখে বোঝার উপায় নাই, এটাই সর্বনাশা পদ্মা।যতদূর চোখ যায়, শুধু ধূ-ধূ মরুভূমির বালু।
১৬ মে, রাজশাহী নদী বাঁচাও আন্দোলন এবং হেরিটেজ রাজশাহী, রাজশাহী মহানগরীর একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে “গঙ্গা চুক্তির অবসান বাংলাদেশের করণীয়” শীর্ষক একটা সেমিনারের আয়োজন করেন।সেমিনারে বক্তারা পদ্ম নদীতে পানির সাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য মাওলানা ভাসানীর দেখানো পথে আন্দোলনের উপর গুরত্ব দেন।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর ড,আফিস নজরুল বলেন, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে সেই ঐতিহাসিক লং মার্চ যথার্থ ছিল।সেইদিন অনেক রাজনীতিবিদই তাকে ঠাট্টার চোখে দেখেছিল।কিন্তু সেই লং মার্চের এতদিন পর আজকে আমরা কী দেখছি ?
দেখছি, দিন দিন পদ্মার বুকে পানি কমছে।ফারাক্কার প্রভাবে আমাদের দেশের মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে।ফারাক্কা বাঁধের সুষম পানি বণ্টনের যে চুক্তি হয়েছিল, সেইদিন তা সঠিকভাবে ব্যবহার হয় নাই বলেই আজকের এই পরিণতি।
নদী গবেষক, হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকী বলেন,চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরাঞ্চলের মানুষ তথা উত্তরাঞ্চলসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল।ফারাক্কা দিন দিন গ্রাস করছে এ অঞ্চলের মানুষের অধিকার।সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া মানুষের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি নিঃস্ব মানুষ গুলোর করুণ আর্তনাদ প্রতিনিয়তই সৃষ্টি করছে শোকাবহ পরিবেশের।
সেভ দ্য ন্যাচার’ চাঁপাই নবাবগঞ্জের প্রধান সমন্বয়কারী রবিউল হাসান ডলার জানান, স্থানীয় পরিবেশবাদীদের মতে পদ্মায় পানি না থাকায় পরিবেশের উপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব।সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উদ্ভিদ ও জীবনচক্র।বিশেষ করে শুশুক ও ঘড়িয়ালের প্রজননস্থল পদ্মা নদী হওয়ায় এই প্রাণি দুটি হুমকির মুখে পড়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, ভূমি ও পানি সমতলের সর্বনিম্ন স্তরের যে ব্যবধান সেটা প্রতিবছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে।আর বৃদ্ধির কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জের নদীর পাড়ের যে স্থিতিশীলতা তা হ্রাস পাচ্ছে।সেই সঙ্গে প্রতিবছরই নদী ভাঙ্গনের তীব্রতা বাড়ছেই।পানির যে প্রবাহ সেটার সঙ্গে বৃষ্টিপাতের সরাসরি সর্ম্পক রয়েছে।
গত ২০ বছরে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে এবং বৃষ্টিপাত হ্রাস পাওয়ার কারণে তাপমাত্রা মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।এ বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী অঞ্চলে ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা ওঠানামা করছে এবং পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
IPCS News : Dhaka : আবুল কালাম আজাদ : রাজশাহী।