সোমবার ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সংবাদ শিরোনামঃ

পশ্চিম রেলে চলছে দুর্নীতির দৌড় প্রতিযোগিতা

আপডেটঃ ১২:৫৩ অপরাহ্ণ | ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২৪

নিউজ ডেস্কঃ

রাজশাহী:- পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভিন্ন দপ্তরে চলছে দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দূর্নীতির দৌড় প্রতি যোগিতা।একে কেওকেও দুর্নীতির সুনামিও বলছে। দরজা-জানালার পর্দা, সংকেত বাতি, ফায়ার এক্সটিংগুইসার, রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস, ফিনাইল, ভিম ও ব্লিচিং পাউডারের মতো পণ্য কিনতে ঠিকাদারকে দেওয়া হয়েছে বাজারমূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বা এরও বেশি দাম।স্টেশনের ওয়েটিং রুমের জন্য জানালার প্রতি পিস পর্দাই কেনা হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার টাকা দরে।এ দামে যে পর্দাগুলো কেনা হয়েছে তার মধ্যে ছয় পিস এখন নাটোর রেলওয়ে স্টেশনের ভিআইপি ওয়েটিং রুমে লাগানো আছে।সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দুটি জানালা ও একটি দরজায় দুটি করে পর্দা লাগানো আছে।স্টেশনের কর্মকর্তারা জানান, প্রায় ১৫ হাজার টাকা দামের পর্দা এ গুলোই।রাজশাহী পর্দা গ্যালারী নামের একটি শোরুম দীর্ঘদিন থেকেই দেশী-বিদেশী সব ধরনের পর্দা বিক্রি করে আসছে।

নাটোর স্টেশনের ওই পর্দার ছবি দেখে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চার কুচির প্রতি পিস এই পর্দার দাম বড়জোর দেড় হাজার টাকা।প্রতিষ্ঠানটির স্বত্ত্বাধিকারী এফাজুর রহমান বলেন, ‘কোথাও ১৫ হাজার টাকা দামের পর্দা নেই।চীন থেকে আনা সবচেয়ে উন্নত পর্দাটির দাম যদি ধরি তাহলে তা সর্বোচ্চ ৩ হাজার ২০০ টাকা।এটার সঙ্গে ডিজাইন করে নিলে বড়জোর চার হাজার টাকা পড়বে।

একটি পর্দার দাম এর চেয়ে বেশি হবে না।অথচ এর কয়েকগুণ বেশি দামে পর্দা কিনেছে রেল।বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের পরিবহন অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষায় রেলের বিভিন্ন পণ্য কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়েছে।প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পশ্চিম রেলে কেনাকাটার মাধ্যমেই কোটি কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে।

২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত এই নিরীক্ষা চলে।গত বছরের ৩০ অক্টোবর পরিবহন অডিট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাইফুর রহমান নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সই করেন।এরপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চলতি বছরের ২৫ জুন প্রতিবেদনটি জাতীয় সংসদে জমা দেওয়া হয়।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পশ্চিম রেলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (সিওএস) কার্যালয় নাটোর রেলওয়ে স্টেশনের ভিআইপি ওয়েটিং রুমে ৫০টি পর্দা সরবরাহের জন্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স বুশরা ট্রেডার্সের সঙ্গে চুক্তি করে।নাটোর স্টেশনে পর্দার প্রয়োজন হলে পাকশীর বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার (ডিসিও) চাহিদাপত্র দেওয়ার কথা।

কিন্তু চাহিদা ছাড়াই ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি করে সিওএস পশ্চিম।১৪ হাজার ৫৯১ টাকা দরে ঠিকাদারকে ৫০টি পর্দার বিলও দেওয়া হয়।তবে বাস্তবে ২৫টি পর্দা পেয়েছে নিরীক্ষা দল।বাকি ২৫টি পর্দা না নেওয়ায় ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৭৫০ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

এদিকে সিওএস পশ্চিম খুলনা রিমডেলিং স্টেশনের জন্য ফিটিংসসহ ২৪৬টি পর্দা কিনতে মেসার্স সরকার ট্রেডার্স নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছিল।এরমধ্যে ৮৪টি পর্দার দাম ধরা হয়েছিল ১৪ হাজার ৫৯৫ টাকা।বাকি ১৬২টি পর্দার দাম ধরা হয় ৭ হাজার ৮৪৮ টাকা।খুলনা রিমডেলিং স্টেশনের মাস্টার মানিক চন্দ্র সরকার সব পর্দা বুঝে নিয়েছেন দেখিয়ে ডেডস্টকে এন্ট্রি করেন।

কিন্তু যাচাইকালে নিরীক্ষা দল বাস্তবে ১৫২টি পর্দা পেয়েছে।অবশিষ্ট ৯৪টি পর্দা না পাওয়ায় গড়ে ১১ হাজার ২২১ টাকা ধরে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ১০ লাখ ৫৪ হাজার ৮২১ টাকা।নিরীক্ষা দল মন্তব্য করেছে, পর্দা কেনা হয়েছে বাজারমূল্যের চেয়ে উচ্চমূল্যে।রেলের দেওয়া মূল্য ঠিক ধরে নিলেও পর্দা না নিয়ে ঠিকাদারকে মূল্য পরিশোধ করায় মোট ১৪ লাখ ১৯ হাজার ৫৭১ টাকা ক্ষতি হয়েছে।

এই টাকা সবাই মিলে আত্মসাৎ করা হয়েছে।নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওই অর্থবছরে ডিটিএস, লালমনিরহাট ও ডিটিও, পাকশী কার্যালয়ের চাহিদা ছাড়াই এসব অফিসের জন্য গার্ডদের জন্য লাগেজ ট্রলি কেনার চুক্তি করা হয়।এছাড়া ডিসিও, পাকশীর চাহিদা ছাড়াই ক্যাশসেফ কিনতে চুক্তি করা হয়।ডিটিএস, লালমনিরহাটের চাহিদার প্রেক্ষিতে হান্ড বেরো প্লাটফর্ম ট্রলি কিনতে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি করা হয়।

এসব পণ্যের মূল্য ধরা হয় ৪১ লাখ ৩৫ হাজার ৪৩৫ টাকা।নিরীক্ষার সময় এসব মালামাল সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে পাওয়া যায়নি।অথচ প্রায় অর্ধকোটি টাকার এই বিল পরিশোধ করা হয়েছে।এই অনিয়মের বিষয়ে অডিট অধিদপ্তর রেলওয়ের প্রিন্সিপাল হিসাব অফিসারকে দুইদফা চিঠি দিলেও কোন জবাব আসেনি।

তাই লুটপাটে জড়িত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এই টাকা আদায় করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করেছে অডিট অধিদপ্তর।ওই নিরীক্ষার সময় পশ্চিম রেলের প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক ছিলেন এএসএম শাহনেওয়াজ।

পশ্চিম রেলে কেনাকাটায় দুর্নীতির সুনামি এখানেই থামেনি।নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, পশ্চিম রেলের মহাব্যবস্থাপকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরের কেনাকাটায় বাজারমূল্যের চেয়ে অধিক মূল্য ঠিকাদারকে পরিশোধ করায় ৫ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৮ টাকা ক্ষতি হয়েছে।

ঠিকাদার ফেরদৌস জামানের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে ফায়ার এক্সটিংগুইসার কেনায় ৫ লাখ ২৭ হাজার ৪৫৫ টাকা এবং প্রাপ্তি এন্টার প্রাইজের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস কেনায় ৫ লাখ ১৬ হাজার ৬২৩ টাকা ক্ষতি হয়েছে সরকারের।সিওএস, পশ্চিমের দপ্তর বাজারমূল্যের চেয়ে অধিক দরে এলইডি ইলেক্ট্রিক চার্জাবেল সিগন্যাল লাইট কেনায় ১৭ লাখ ৬৩ হাজার ৫৩১ টাকা ক্ষতি হয়েছে।

প্রাক্কলনে কাল্পনিক মূল্য নির্ধারণ করে চিকিৎসা বিভাগের জন্য কনজারভেন্সী মালামাল কেনা হয়েছে দ্বিগুণ, তিন গুণ বা তারও বেশি দামে।এতে ১ কোটি ১১ লাখ ৮৮ হাজার ৯০৬ টাকা গচ্চা গেছে রেলের।তৎকালীন প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা উচ্চমূল্যে চিকিৎসাসামগ্রী কিনে গচ্চা দিয়েছেন আরও ১ কোটি ১১ লাখ ৬৬ হাজার ৮১৭ টাকা।

পশ্চিমের প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলীর দপ্তরে অধিক মূল্যে কেনাকাটার মাধ্যমে লুটে নেওয়া হয়েছে ১৩ লাখ ৪২ হাজার ১৪৮ টাকা।এছাড়া সিওএস দপ্তর উচ্চমূল্যে প্রাক্কলন করেন পণ্য কেনায় আরও ২ কোটি ৮১ লাখ ৫১ হাজার ৪১৩ টাকা ক্ষতি হয়েছে রেলের।

প্রাক্কলন প্রণয়নকারী, অনুমোদনকারী, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি, দরপত্র মূল্যায়ন সুপারিশ অনুমোদনকারী এবং ঠিকাদারের যোগসাজশে বিপুল পরিমাণ এই অর্থ লুটে নেওয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।নিরীক্ষা দলের কাছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো এসব অনিয়মের কিছু জবাব দিয়েছে।

কেনাকাটায় অনিয়ম হয়নি দাবি করে পশ্চিমের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তার দপ্তর বলেছে, জরুরিভিত্তিতে সব মালামাল প্রয়োজন ছিল।তখন বাজারমূল্য বেশি ছিল। তাই ওই দামেই কিনতে হয়েছে।তাছাড়া প্রাক্কলনের সময় মুদ্রাস্ফীতির কথা চিন্তা করে বেশি দাম ধরা হয়েছিল।বেশি দামে পর্দা কেনা এবং মালামাল গ্রহণ না করেই বিল পরিশোধের বিষয়ে সিওএস দপ্তর তেমন ব্যাখাই দিতে পারেনি।

এতে খুবই অসন্তোষ প্রকাশ করেছে পরিবহন অডিট অধিদপ্তর।অডিট অধিদপ্তর বলেছে, যে জবাব কর্মকর্তারা দিয়েছেন তা আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সহায়ক নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাল্পনিক মডেল উল্লেখ করে পণ্যের বেশি দাম দেখানো হয়েছে।সরবরাহকারী মালামালের মূল্য কোটেড করার ক্ষেত্রে মুনাফাসহ সবকিছু বিবেচনা করেই মূল্য নির্ধারণ করেন।

এক্ষেত্রে কোটেড মূল্য অপেক্ষা বেশি মূল্যে প্রাক্কলন করার কোন সুযোগ নেই।তাই মালামাল কেনার সঙ্গে থাকা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অধিক খরচকৃত অর্থ আদায় করে সরকারী কোষাগারে জমা করার সুপারিশ করেছে অডিট অধিদপ্তর।পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার বলেন, যারা এসব অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন তারা কেউ পার পাবেন না।

ইতোমধ্যে পর্দা কেনাকাটার সঙ্গে জড়িত থাকা তৎকালীন প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক এএসএম শাহনেওয়াজ বরখাস্ত হয়েছেন।আরও কয়েকজনের ব্যাপারে তদন্ত চলছে।

IPCS News : Dhaka : আবুল কালাম আজাদ : রাজশাহী।