সোমবার ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সংবাদ শিরোনামঃ

আমের রাজধানী চাঁ,নবাবগঞ্জেই রয়েছে ৩৫০ জাতের আম, সংরক্ষণ করবে, “বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়াম”

আপডেটঃ ১২:৩২ অপরাহ্ণ | এপ্রিল ০৬, ২০২২

নিউজ ডেস্কঃ

রাজশাহী :- ১৯৪০ সালের আগ পর্যন্ত বিশাল আম-বাগানটির মালিকানা ছিল ইংরেজদের।দেশভাগের পর ব্রিটিশরা বাগানটি তৎকালীন কানসাট এলাকার জমিদার কুজা রাজার কাছে বিক্রি করে দেয়কিছুদিন ভোগের পর কুজা রাজা সব সম্পদ রেখে ভারতে চলে গেলে আমবাগানসহ সব সম্পত্তি যায় সরকারের নিয়ন্ত্রণে।তখন থেকেই সরকার-নিয়ন্ত্রিত কুজা রাজার আম-বাগানটি।১৯৬৬ সালের দিকে বাগানটি পরিচর্যা ও দেখাশোনার দায়িত্ব পায় ঢাকার হর্টিকালচার।সে সময় বাগানে ছোট ছোট আমগাছ লাগানো হয়।প্রায় ৫ থেকে ৬ বছর থাকার পর বাগান ছেড়ে চলে যায় তারা।তখন থেকেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বাগানটি দেখাশোনা করে।কিন্তু জেলা প্রশাসনের সঠিক তদারকি না থাকায় ধ্বংস হতে থাকে বাগানটি।একের পর এক গাছ মারা যেতে থাকে।পরিত্যক্ত বাগানটি পরিণত হয় মাদকসেবীদের আস্তানায়।

ঐতিহ্যবাহী বাগানটি রক্ষার জন্য উদ্যোগ নেয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসন।শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটের এই বাগানকে ঘিরে নেওয়া হয় নানা পরিকল্পনা।দেশে প্রথমবারের মতো বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্মাণ করা হচ্ছে আমের জন্য মিউজিয়াম।যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়াম।র্তমানে অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি বাগানটির গাছগুলো রক্ষায় পরিচর্যার কাজ চলছে।

মাদকের আস্তানা ও অবৈধ বস্তি তুলে দিয়ে পুরো বাগানটি পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে।জেলার ৩০০ জাতের আমগাছ এ বাগানে ২০টি জোনে ভাগ করে সংরক্ষণ করা হবে।আমের রাজধানীখ্যাত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের সব আমের জাত রক্ষায় জামপ্লাজম সেন্টারসহ তৈরিসহ নানা পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে।ইতোমধ্যে প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয়ে দেওয়া হয়েছে সীমানাপ্রাচীর।

জেলা প্রশাসন সম্প্রতি বেনামে থাকা জাতগুলোর ১০০ জাতের আমের নাম দিয়েছে।এসব জাত সংরক্ষণে নেওয়া হয়েছে বিশেষ উদ্যোগ।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরই শেষ হবে লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়ামের নির্মাণকাজ।ফলে এসব জাতের আমের বাজারমূল্য বৃদ্ধি পাবে।ম্যাংগো টুরিজম হিসেবে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে এই মিউজিয়ামের নাম।

সরেজমিন বাগান ঘুরে দেখা, জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট মৌজার পার-কানসাট ও মোবারকপুর ইউনিয়নের শিকারপুর মৌজা মিলিয়ে প্রায় ৩২ একর ৯৮ শতাংশ বা প্রায় ১০০ বিঘা জমিতে ছোট-বড় মিলিয়ে তিন হাজার আমগাছের মধ্যে এখন রয়েছে প্রায় দুই হাজার আমগাছ।ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের বেশ কিছু আমগাছ এখনো টিকে আছে।

বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়ামে নির্মাণ করা হচ্ছে পিকনিক স্পট।নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে এখান থেকে বিভিন্ন জাতের আমের গাছ ও কলম সংগ্রহ করতে পারবেন কৃষকেরা। এ ছাড়া কৃষকদের দেওয়া হবে আমের চাষের জন্য প্রশিক্ষণ।

শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিডেটের সাধারণ সম্পাদক ও আম রপ্তানিকারক ইসমাঈল খান শামিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমচাষি ও রপ্তানিকারকদের দীর্ঘদিনের একটি দাবি ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের জন্য একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান নির্মাণের।

এমন উদ্যোগ নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ।আমরা জেনেছি, বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়ামে গত ২০০ বছরের নানা জাতের জার্মপ্লাজম সংরক্ষণ করা হবে।আধুনিক জার্মপ্লাজম সেন্টারের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে এসব জাতের আমের সম্প্রসারণে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানায়।তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রত্যাশা, বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়াম আম নিয়ে সামগ্রিকভাবে কাজ করবে।

আমের গবেষণা, বাজারজাতকরণ, সম্প্রসারণ, রপ্তানিতে প্রক্রিয়াজাতকরণসহ সব কাজ করার দাবি জানায়।বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়ামকে ঘিরে এখানকার ম্যাংগো ট্যুরিজম সম্প্রসারিত হবে।এই প্রতিষ্ঠান দেখে আশপাশের আম-বাগানিরা বাগান তৈরি করবেন এবং দেশ-বিদেশের পর্যটকরা আম-বাগান দেখতে আসবে।

আমচাষি রনি আহমেদ জানান, এখানে সব জাতের আম সংরক্ষণ করা হবে।তাই স্থানীয় কৃষকরা খুব সহজেই এখান থেকে সায়ন সংগ্রহ করে বিভিন্ন জাতের আম নিজেদের আমবাগানে চাষাবাদ করতে পারবে।বাইরে থেকে মূল্য ও অধিক ঝুঁকি না নিয়ে আর চারা বা সায়ন সংগ্রহ করতে হবে না।এ সময় বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়ামের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

বাগানে পরিচর্যার নানা কাজ করেন কানসাট ইউনিয়নের বাঁশমহল এলাকার আব্দুর রহিম (৫৫)।তিনি বলেন, ছোট থেকেই আমরা দেখছি বাগানটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল।পরিচর্যা করার কোনো লোকজন ছিল না।এরপর সম্প্রতি ইউএনও সীমানাপ্রাচীর দেওয়ার পর গাছগুলোর পরিচর্যা করতে শুরু করে।এখন গাছগুলোতে যাতে পোকার আক্রমণ না হয়, তাই স্প্রে করছি।

উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন মাহফুজ আলম মিম।বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে এসে তিনি বলেন, চমৎকার সুন্দর একটি জায়গা।বাগানটি দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। চাঁপাইনবাবগঞ্জকে বলা হয়ে থাকে আমের রাজধানী।এই রাজধানীর একটি বিশাল পরিত্যক্ত বাগানকে যারা এত সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে, তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

এই মিউজিয়ামের মাধ্যমে দেশের মধ্যে ছাড়াও বিশ্বে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের সুনাম ছড়িয়ে পড়বে।স্থানীয় আম ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জানান, বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়াম নামে যে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠেছে, তাতে আমরা স্থানীয় আম ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত আনন্দিত।কারণ দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়াম পরিদর্শনে আসবে।

আমরা জানি, একটি নির্দিষ্ট এলাকা তখনই বেশি অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করতে পারে, যখন সেখানে বাইরে থেকে পর্যটকরা আসে।চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ব গবেষনা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু সালেহ মো. ইউসুফ বলেন, সারাদেশের আমের জন্য এমন বিশেষ কোনো প্রথম প্রতিষ্ঠান হলো বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়াম।

পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জাতগুলোর সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।এমনকি হারিয়ে যাওয় জাতগুলোও সংরক্ষণ করা যাবে।জাত উন্নয়ন ছাড়াও আমের চাষাবাদ সম্পর্কে জানতে পারবেন কৃষকরা।শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাকিব-আল-রাব্বী জানান, আমের জেলা হিসেবে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ।

এখানে নামিদামি আমের চেয়ে বেনামি ও অপরিচিত আমের সংখ্যাই বেশি।জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এমন ১০০ জাতের আমের নাম দেওয়া হয়েছে।এসব আমের মধ্যে এমন অনেক আম আছে, যেগুলো স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয়।নাম-পরিচয় বা প্রচার না থাকায় এসব আম বাজারে কদর পায় না। দামও পান না চাষিরা।ফলে অনেকেই গুটি জাতের এসব আম গাছ কেটে ফেলছেন।

এতে অনেক সুস্বাদু আমও বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং বিলুপ্তির পথে আছে আরও অনেক জাত।এখন থেকে নতুনভাবে নাম পাওয়া জাতগুলো সংরক্ষণ করা হবে এই মিউজিয়ামে।তিনি আরও বলেন, আমকেন্দ্রিক পর্যটন বিকাশে এবং সুস্বাদু আম রক্ষা ও জনপ্রিয় করতেই সরকারের ডেল্টা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জেলার কানসাটে এ মিউজিয়ামটি গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন।

পাশাপাশি বাগানের একপাশে থাকবে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় কিছু স্পট।জেলায় প্রতি মৌসুমে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ আম নষ্ট হয়।এখন আম রক্ষার উপায় জানতে পারবেন কৃষকরা।উল্লেখ্য, গত বছর ম্যাংগোপিডিয়া নামে ১০০টি প্রচলিত ও জনপ্রিয় আমের একটি প্রকাশনা অ্যালবামও প্রকাশ করেছে জেলা প্রশাসন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রায় ৮০০ জাতের আম।এর মধ্যে আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জেই রয়েছে ৩৫০ জাতের আম।

IPCS News : Dhaka : আবুল কালাম আজাদ : রাজশাহী।